সম্মানিত মুসলিম পাঠক, আসছে কোরবানির ঈদ এই ঈদে কুরবানী দেওয়ার জন্য অবশ্যই আপনারা কোরবানির নাম দেওয়ার নিয়ম এবং ৭ ভাগে কুরবানীর দলিল জানার জন্য আগ্রহী। এই আর্টিকেলে আর্টিকেলে থাকছে এর সমস্ত কিছু এবং কোরবানি কত জনে দেওয়া যায়,কুরবানী দেওয়ার সঠিক নিয়ম তার বিবরণ তাই মনোযোগ সহকারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
নামাজ হলো ইসলামের দ্বিতীয় ইবাদত।নামাজ ফরজ। এবং কুরবানী করা ওয়াজিব। ওয়াজিবকে প্রাধান্য দেওয়ার আগে ফরজ কাজ সম্পর্কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেহেতু কুরবানী কে সবার জন্যে ওয়াজিব নয় অপরদিকে নামাজ সকলের জন্য ফরজ এই দিক দিয়ে বোঝা যায় নামাজ অবশ্যই কায়েম করা জরুরী। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন
‘আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি আদায় করুন।’ (সুরা কাউসার: ২)।হযরত মুহাম্মদ (স.) কঠোরভাবে ইরশাদ করেছেন যে ‘কোনো ব্যক্তি এবং কুফর ও শিরকের মধ্যে ব্যবধান শুধু নামাজ না পড়া। যে নামাজ ছেড়ে দিল সে কাফের হয়ে গেল (কাফেরের মতো কাজ করল)’ (সহিহ মুসলিম: ৮২)। রাসুলুল্লাহ (স.) আরও ইরশাদ করেন, ‘আমাদের ও কাফেরদের মধ্যে ব্যবধান শুধু নামাজের। যে নামাজ ত্যাগ করল সে কাফের হয়ে গেল।’ (তিরমিজি: ২৬২১)
সুতরাং নামাজের সাথে কোরবানির সম্পূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা যায়নি তবে আলেমরা বলেন বেনামাজিকে কুরবানীর ভাগের সাথে শরিক না বানানোই ভালো কেননা নামাজ থেকে বিরত থাকা ব্যক্তি কোরবানি কতটা কবুল হবে তা সঠিক জানা নেই। তাই সর্বোত্তম হয় বেনামাজি এড়িয়ে চলা। এবং হাদিসে রয়েছে ‘এমন শরিক খুঁজে বের করা যারা শরিয়তের যাবতীয় বিধি-বিধান যথাযথ মেনে চলে।’ (সহিহ মুসলিম: ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৮)
কোরবানির ভাগের নিয়ম
কুরবানির বিধান রয়েছে কেউ একা কোরবানি দিবেন আবার কেউ শরিকের সাথে বা ভাগে কুরবানী দিবেন। ইসলামী শরীয়তে কুরবানী করার বিষয়ে বেশ কিছু বিধান রয়েছে। ছাগল ভেড়া দুম্বা শুধু একজনই কুরবানী দিতে পারবে এগুলো একাধিক ব্যক্তি ভাগে কুরবানী দেওয়া সহীহ নয়। অপরদিকে উট,গরু,মহিষ কুরবানী করার বিষয়ে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে।
সাতজনের অধিক শরিক হলে কোরবানি সহীহ হবে না।সাতজনের কম সংখ্যা যেমন দুই,তিন,চার,পাঁচ ও ছয় ভাগে কোরবানি করা যায় সহীহ মুসলিমের হযরত জাবের (রা.) বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায় তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে হজ করেছিলাম, তখন আমরা সাতজন করে একটি উট এবং একটি গরুতে শরিক হয়ে কোরবানি করেছি।
কোরবানি করার শরিকের কারো অংশ এক সপ্তম অংশের কম হবে না অর্থাৎ সর্বনিম্ন সাত ভাগের এক ভাগ অংশের শরিক হতে হয়।কেউ যদি দেড় ভাগ অথবা হাফ ভাগ কোরবানি দিতে চাই তবে কোন শরীকেরই কুরবানী সহীহ হবে না।অতএব মূল কথা হলো কোরবানি একজন অথবা সাত জন মিলে করা যায়।গরু,উট ও মহিষের ক্ষেত্রে ২,৩,৪,৫, ৬ ও সর্বোচ্চ সাত ভাগে কুরবানী দেওয়া জায়েজ আছে।
৭ ভাগে কুরবানীর দলিল
وَعَنْ جَابِرِ بنِ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ: نَحَرْنَا مَعَ النَّبِيِّ - صلى الله عليه وسلم - عَامَ الْحُدَيْبِيَةِ: الْبَدَنَةَ عَنْ سَبْعَةٍ، وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
অর্থাৎঃ হযরত জাবির ইবনু আবদিল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিঁনি বলেন, আমরা হুদাইবিয়ার বছর (৬ষ্ঠ হিজরিতে) দয়াল নবী মুস্তফা ﷺ - এর সাথে থেকে একটা উট সাতজনের পক্ষ থেকে এবং একটা গরু সাত জনের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছিলাম।
তথ্যসুত্রঃ--
ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম , হা, নং,২৮০৯
ইমাম নাসাঈ, সুনানে নাসায়ী , হা,নং,১৩৯১৩
ইমাম আবু দাউদ, সুনানে আবি দাউদ , হা,নং,১৩১৮
ইমাম ইবনু মাজাহ, সুনানে ইবুন মাজাহ ,হা, নং,১৩৩২
ইমাম আহমদ, মুসনাদে আহমাদ , হা, নং,১৩৯১৩
ইমাম দারেমী, সুনানে দারেমী , হা, নং, ১৯৩৪
বিশ্ব বিখ্যাত ইমাম মুসলিম (রহ.) একখানা হাদিস বর্ণনা করেনঃ----
হযরত জাবির ইবনু আব্দিল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিঁনি বলেন, আমরা হজ্জ ও উমরাহ পালনকালে দয়াল নবী মুস্তফা ﷺ -এর সাথে সাতজনে মিলে একটি উট কুরবানী করেছি। অতঃপর জনৈক ব্যক্তি হযরত জাবির (রা.)-কে জিজ্ঞেস করল, বাদানাহ তে (যে ক’জন) শারীক হতে পারে জাযুরেও কি অনুরূপ শারীক হওয়া যায়? তখন তিঁনি বললেন, এটি (বাদানাহ ও জাযুর) তো একই। আর হযরত জাবির (রা.) হুদায়বিয়ায় উপস্থিত ছিলেন। তিঁনি বলেন, আমরা ঐদিন ৭০টি উট কুরবানী করেছি এবং প্রতিটি উটেই ৭ জন শারীক ছিলাম।
ইমাম মুসলিম, সহিহ মুসলিম, হা,নং,৩০৭৯
শায়েখ ইবনে উসাইমীন রহ. বলেন,
“ছাগল শুধু এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করা যাবে। আর উট-গরুর এক সপ্তমাংশ একটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত হবে। এর দলিল হল, সহীহ মুসলিমে বর্ণিত জাবের রাযি.-এর হাদিস। তিনি বলেন, “আমরা হুদায়বিয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাত শরীকে একটি উট এবং সাত শরীকে একটি গরু কুরবানী করেছি।” -আহকামুল উযহিয়্যা, পৃ: ২/২৩০
কোরবানি কয় নামে দেওয়া যায়
শরিকদের সর্বোচ্চ সাত নামে পশু কোরবানি করা জায়েজ। তবে অনেকে মনে করে থাকেন সাতটি নাম দেওয়া অবশ্যই জরুরি। এমনটা একদমই নয় কোরবানির পশু কেনার সময় অর্থ অনুযায়ী যতজন শরিক তা কিনবেন অর্থাৎ সর্বোচ্চ সাতজন থাকবে সবাই সমান অর্থ দেবে এবং মাংস ভাগ নেবে। সর্বোচ্চ সাতজনের জায়েজ রয়েছে তবে এ ধারণা সঠিক নয় যে সাতজন শরিক রাখা আবশ্যক।
গরু এক নামে কুরবানী করা যায় ।একইভাবে দুই,তিন,চার,পাঁচ,ছয় নামেও কোরবানি করা যায়। একটি পশু এক,দুই,তিন করে সর্বোচ্চ সাত নামে কোরবানি করা জায়েজ এর বেশি নয়। এবং ছাগল ভেড়া দুম্বা এই তিন পশু একজনের নামে কুরবানী করতে হয়। তাই কুরবানী কয় নামে দেওয়া যায় বলতে গেলে এক কথায় ছাগল ভেড়া দুম্বা এক নামে এবং গরু মহিষ ১,২,৩,৪,৫,৬ ও সর্বোচ্চ ৭ নামে দেওয়া যায়।
কোরবানির নাম দেওয়ার নিয়ম
কোরবানি দেওয়ার সময় কুরবানি দাতার নাম উল্লেখ করা জরুরি এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাই করার সময় কার পক্ষ থেকে কুরবানী হচ্ছে তার নাম মুখে উল্লেখ করেনি। তাই পশু জবাই করার সময় কুরবানী দাতার নাম উল্লেখ করা সুন্নত নয়। আমাদের মহানবী (স.) পশু জবাই করার সময় বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বলেছেন।
তবে কুরবানির আগে কারা কোরবানি দিচ্ছে তার নিশ্চিত হওয়ার জন্য নাম গুলো পাঠ করা যেতে পারে কিন্তু এটি আবশ্যিক নয়। তবে হাদিসের এক জায়গায় বলা হয়েছে এভাবে উল্লেখ করলেও হবে যে ‘আমরা অমুক বলছি, আমাদের কোরবানি কবুল করুন, অথবা সবার তরফ থেকে কোরবানি কবুল করুন।’(সহীহ বুখারী-৫৫৫৮, সহীহ মুসলিম -১৯৬৬)
৬ ভাগে কুরবানী দেওয়া যাবে কি
অনেকেই মনে করেন ভাগে কুরবানী দিতে সাত ভাগ এবং সাত শরিক আবশ্যিক। সর্বউচ্চ সাত ভাগে কুরবানী করা বৈধ অর্থাৎ কেউ যদি সাত ভাগের এক ভাগ কোরবানি দেয় তাও জায়েজ এবং দুই ভাগ,তিন ভাগ এমনকি একজন একাই একটি পশু কুরবানী দিতে পারে।এক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভাগ নফল ইবাদত হিসাবে যুক্ত হবে। তাই একটি পশু ছয় ভাগে কুরবানী দেওয়া জায়েজ।
কাসানী বলেন, “এতে কোন সন্দেহ নেই যে, গরু কিংবা উট সাতজনের কম ব্যক্তির তরফ থেকেও কুরবানী বৈধ। যেমন একটি গরু বা উটে ২, ৩, ৪, ৫ বা ৬ জন শরিক হতে পারে। যেহেতু যখন সাত ভাগের এক ভাগ কুরবানী বৈধ, তখন তার বেশি অধিকরূপে বৈধ। চাহে তাদের সকলের অংশ একই রকম হোক অথবা ভিন্ন রকম। যেমন কারো অর্ধেক, কারো তিন ভাগের এক ভাগ এবং কারো ছয় ভাগের এক ভাগ; অবশ্য সাত ভাগের এক ভাগ থেকে কম যেন কারো না হয়।” ৪৬১ (বাদাইয়ুস স্বানায়ি ৫/১৭)
কুরবানী দেওয়ার সঠিক নিয়ম
উপরের আলোচনা করা হয়েছে কোরবানির নাম দেওয়ার নিয়ম ও ৭ ভাগে কুরবানীর দলিল।কিন্তু জেনে নেওয়া উচিত কোরবানি দেওয়ার সঠিক নিয়ম কি? গরু ছাগল মহিষ ভেড়া উট ইত্যাদি কোরবানি করা হয় আমাদের দেশে। কিন্তু জেনে না জেনে আমরা অনেক ভুলভ্রান্তি করে ফেলি। তাই সঠিক নিয়ম অনুযায়ী কুরবানী দিলে পশু জবাহ করা যায় সহজে।
- যারা পশু জবাই করবে তাদের অজু করে নিতে হবে
- কেবলামুখী করে পশু মাটিতে সোয়াতে হবে
- পশুকে পা পাঁজরের উপর, দক্ষিণ দিকে মাথা করিয়ে কেবলামুখী করে সোয়াতে হবে
- পশুর পা শক্ত করে বেঁধে নিতে হবে
- গলাই ছুরি চালানোর সময় বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলতে হবে ।
- উটকে নাহর করা যায় অর্থাৎ দাঁড়িয়ে জবাহ করা যায়।নাহর করলে রক্তক্ষরণ হয়ে উট মাটিতে শুয়ে পড়ে এবং মৃত্যু হয়।
- আগে থেকেই জবাহ করা ছুরি বা চাকুরী শান দিয়ে ধারালো করে রাখতে হবে যাতে পশুর কষ্ট কম হয় এবং তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়।
- যিনি বা যারা কোরবানি দিচ্ছেন তাদের নিজের হাতে জবাহ করা উত্তম।
- ছুরির ধারালো বা সূচালো অংশ দিয়ে পশুকে খোঁচাখুঁচি করা যাবেনা এতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে জানা যায় খোঁচাখুঁচির ফলে মৃত্যুর আগে হার্ট ফেল করে।
- আরামের সঙ্গে জবাই করতে হবে যাতে পশু ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যায়
- ছুরি চালানোর পর পশু নড়াচড়া করা অবস্থায় কাটাকুটি করা যাবে না এতে সুন্নত অনুযায়ী জবাই হয় না বরং এটিকে হত্যা করা বলা হয়।
মন্তব্য
প্রত্যেক ঈদুল আযাহায় কোরবানি করা মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব।কিভাবে জবাহ করতে হয় অর্থাৎ কুরবানী দেওয়ার সঠিক নিয়ম না জানা থাকলে কুরবানী না হয়ে পশু হত্যা হয়ে যেতে পারে এবং কোরবানির নাম দেওয়ার নিয়ম ও ৭ ভাগে কুরবানীর দলিল সঠিক জানা থাকলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই গুরুত্বপূর্ণ এ ওয়াজিব কাজটি করার আগে পোস্টটি ভালো লাগলে গুরুজনদের সাথে শেয়ার করে দিতে পারেন। এতক্ষণ সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url